পরচর্চা মহাপাপ।

প্রকাশিত: ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২৫, ২০২৩

পরচর্চা মহাপাপ।
booked.net

গিবত শব্দের অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা ইত্যাদি। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরার নাম গিবত। এটি মানুষের আমলখেকো বদভ্যাস। গিবত করা ইসলামে কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। অথচ আমাদের সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধি এটি । হাজারো আলোচনার মাধ্যমেও এ থেকে মানুষকে ফিরানো যাচ্ছে না। আজকাল এর বিস্তার চরম আকার ধারণ করেছে। এর মূল কারণ হলো গিবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের ধারণার অভাব।

গিবত কাকে বলে? অনেকেই এটা ভালো ভাবে জানে না। গিবতের পরিণাম ও ভয়াবহতা কী? সে সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা নেই। ফলে দু’চারজন লোক এক জায়গায় উপস্থিত হলেই আমরা অহরহ গিবত করে থাকি। গিবতের সংজ্ঞা? সাধারণত বিনা প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির দোষ অপরের নিকটে উল্লেখ করাকে গিবত বলা হয়। অর্থাৎ কারো অবর্তমানে তার দোষ বর্ণনা করাকেই গিবত বলা হয়েছে।

কেউ কেউ মনে করেন, মিথ্যা দোষ বর্ণনা করা গিবত, সত্য দোষ বর্ণনা করা গিবত নয়। আবার কারো কারো ধারণা যে, একজন ব্যক্তির যে দোষ সবাই জানে সেটা বর্ণনা করা গিবত নয়। যে দোষ লোকজন জানে না সেটা বর্ণনা করলে গিবত। এ ধরনের ধারণাও ভুল। ইবনুল আসির রহ. বলেন, গিবত হলো কোন মানুষের এমন কিছু বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা হয়, এটা কেউ বলুক তা সে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে। চাই মুখে হোক আর লেখনীতে হউক। কোন মুসলমানের নিকট হউক আর অমুসলিমের নিকট হউক। আর যদি না থাকে মিথ্যা বানিয়ে বর্ণনা করা হয় তাহলে তা হবে অপবাদ।

রাসূলুল্লাহ (সা:) একদিন সাহাবায়ে কেরামদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা জান গিবত কাকে বলে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা:) ভালো জানেন। জবাবে রাসূল (সা:) ইরশাদ করলেন, গিবত হচ্ছে তোমার অপর ভাইয়ের এমন দোষ বর্ণনা করা যা সে শুনলে অসন্তুষ্ট হবে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা:)! বর্ণনাকৃত সেই দোষ যদি তার মাঝে থাকে তবে কি গিবত হবে? রাসূল (সা:) বললেন- যার দোষ বর্ণনা করা হবে তার মাঝে যদি এ দোষ বিদ্যমান থাকে তবে তা গিবত হবে। আর যদি না থাকে তবে সেটা হবে বুহতান বা অপবাদ। (মুসলিম) আবার অনেকে মৃত ব্যক্তির দোষ বর্ণনা করে। এটাও হারাম। কারণ রাসূল (সা:) বলেছেন- তোমাদের কেউ মারা গেলে তাকে ছেড়ে দাও। তার গিবত করো না। তিনি আরো বলেছেন- তোমরা মৃতদের ভালো গুণসমূহ আলোচনা কর এবং মন্দ আলোচনা থেকে বিরত থাক। আমরা যেভাবে গিবত করে থাকি- অমুক ব্যক্তি দারুণ কৃপণ, পোশাক-পরিচ্ছদও ভালো পরে না। অমুক রঙচঙ্গা পোশাক পরিধান করে। কিংবা অমুক মেয়েটা লজ্জাহীন। ঠিকমত পর্দা করে না। সতর খোলা থাকে, পেট খোলা থাকে। এসব সত্য কথা বলাও গিবত। অমুকের বংশ ভালো নয়। তার বাপ-দাদা হীন বা নীচু বংশীয় ছিল। কিংবা তারা নিচুমানের পেশার কাজ করত। অমুক তো জোলার বংশ। অমুক তো খুলুর বংশ। এভাবে বংশধারা নিয়ে কথা বলাও গিবত হবে।

কারো অভ্যাস বা আচার আচরণ নিয়ে আলোচনা করাও গিবত। যেমন- অমুক একটা কাপুরুষ। নিতান্ত দুর্বলচেতা মানুষ। অমুক ভীষণ পেটুক। খালি খাই খাই করে বেড়ায় । চালচলনে ভদ্রতা বা শালীনতা রক্ষা করে চলে না। অমুক স্ত্রীর কথায় চলে। অমুক লোকটা দেখতে সোজাসাপ্টা মনে হয়, আসলে খুব ধূর্ত ইত্যাদি কথাও গিবত। কেননা কোন এক সাহাবী জনৈক লোক সম্পর্কে বললেন- সে অত্যন্ত দুর্বল। এ কথা শুনে রাসূল (সা:) বললেন- তোমরা তার গিবত করেছ এবং তার গোশত ভক্ষণ করেছ। কারো ইবাদত সম্পর্কে আলোচনা করা। যেমন- অমুক ভালোভাবে নামায আদায় করে না। তার রুকু সিজদা ঠিক মতো হয় না। অমুক তাহাজ্জুদ পড়ে না, নফল নামায পড়ে না। অমুক রোজা রেখে মিথ্যা কথা বলে। অমুকের দাড়ি ছোট। অমুক দাড়ি কাটে, টুপি পরে না, শার্ট-প্যান্ট পরে, এসব বলাও এবাদত সম্পর্কিত গিবত। কারো গুনাহের কথা অন্যের কাছে বলাও গিবত। অমুকে জেনা করেছে, অমুকে অমুকের গিবত করেছে, অথবা সে অত্যন্ত ঈর্ষাপরায়ণ, সে মিথ্যা বলে; কারো সম্পর্কে এরূপ বলাও গিবত।

ইঙ্গিতে কারো সম্পর্কে কিছু বলাও গিবত। যেমন- কাউকে ইঙ্গিত করে কেউ বললেন- কিছু কিছু মানুষ স্ত্রীর তাঁবেদারি করে। কিছু কিছু মানুষ দাড়ি কাটে। কিছু কিছু মানুষ মিথ্যা কথা বলে। কাউকে সামনে রেখে এরূপ ইঙ্গিত করে কথা বলাও গিবত। গিবত শোনাও মহাপাপ- কারো গিবত শুনে চুপ থেকে প্রতিবাদ না করাও কানের গিবত। কেননা গিবত শুনে চুপ থাকা এবং প্রতিবাদ না করা নিজেই গিবত করার শামিল। রাসূল (সা:) বলেছেন- যখন কারো গিবত করা হয় আর তুমি সে মজলিসে বসা থাক তখন তুমি গিবতকৃত ব্যক্তির সাহায্যকারী হও। যার গিবত করা হচ্ছে তুমি তার প্রশংসা শুরু করে দাও, যাতে মানুষ তার গিবত হতে বিরত হয়। গিবতকারীকে গিবত করা হতে নিষেধ কর, নতুবা মজলিস হতে চলে যাও। কেননা চুপচাপ বসে থাকলে তুমিও গিবতকারী হিসেবে গণ্য হবে। যেমন- মায়মুন বিন সিয়াহ (রা.) নিজের অবস্থার বর্ণনায় বলেন- একদিন আমি ঘুমাচ্ছিলাম, স্বপ্নে দেখলাম আমার সামনে এক মৃত হাবশীকে এনে কেউ বলছে, হে মায়মুন, তুমি এ মৃত হাবশীকে খাও। আমি বললাম- আমি কেন মৃত হাবশীকে খাব। সে বলল- তুমি অমুকের গিবত করেছ। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি তার গিবত করিনি। সে বলল- যদিও তুমি গিবত করনি তবে শুনেছ। আর গিবত শুনা আর গিবত করা একই রকম গোনাহ। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা:) বলেন, ‘গিবত জেনা থেকেও মারাত্মক গুনাহ।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, গিবত জেনা থেকেও মারাত্মক কিভাবে? তিনি বললেন, ‘জেনাকারী তওবা করলে আল্লাহ তওবা কবুল করেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। আর গিবতকারীর তওবা কবুল হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত যার গিবত করা হয়েছে, সে ক্ষমা না করে।’ (বায়হাকি)।

★ লেখক: গবেষক-কলামিস্ট।

Ad