পণ্য মূল্যের লাগাম টানুন- এ.এফ.এম ফৌজি চৌধুরী।

প্রকাশিত: ৭:৩১ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩

পণ্য মূল্যের লাগাম টানুন- এ.এফ.এম ফৌজি চৌধুরী।
booked.net

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া ছুটছে দামাল গতিতে। আমাদের প্রতিদিনের নিত্যপণ্যের উর্ধ্বমুখী দামের জন্য সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।।নানা কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট কলকারখানা। বিপুল সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকের অর্থনৈতিক অবস্থা দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছে। প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে নিত্য পণ্যের দাম। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল, ছোলা, জিরা, আদা, রসুন ও ডিমের দাম এখন আগুন ছোঁয়া। যে সময় মানুষের প্রয়োজন পর্যাপ্ত আমিষ জাতীয় খাদ্য, তখনই বেড়েছে ডিম, মুরগি এবং মাছের দাম। প্রয়োজন এবং প্রাপ্তির মধ্যে বেশ ব্যবধান রয়েছে।

সীমিত আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে অনেক প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য। স্বল্প আয়ের মানুষের খুবই কষ্টকর অবস্থা আর যাদের একেবারেই সঞ্চয় নেই কিংবা প্রতিদিন দিনমজুরির আয়ে সংসার চলে তাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রতিদিন বেঁচে থাকায় সমস্যা।

মূল্যস্ফীতিতে নাকাল সাধারণ মানুষ। মুল্যস্ফীতি কেন সহনীয় পর্যায়ে নেই বা বাজার কেন স্থিতিশীল হচ্ছে না, এর কারণ কেবল করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশি^ক মূল্যস্ফীতি নয়, এর পিছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি, অতি মুনাফাখোরী প্রবণতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্তভোগীদের প্রভাব। চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসলা ইত্যাদির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটি কয়েক ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীদের নানা সুযোগ সুবিধা সরকার বিভিন্নভাবে দিয়ে গেলেও তার সুফল জনগণ পাচ্ছে না।তারা যে পণ্য উৎপাদন করে তার মূল্য নির্ধারনের ক্ষমতা সরকারের নেই। যতই উন্নয়নর কথা বলা হোক, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা যদি সহজ না হয়, সাবলীল ও আয়ত্তের মধ্যে না হয় তাহলে উন্নয়ন অনেকের কাছেই অর্থহীন। তাই মূল্যাস্ফীতির প্রকোপ কমিয়ে আনতে হবে। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া থামাতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের চরম ব্যর্থতার কথা জনগণ মুখে বলতে না পারলেও তাদের বুকে ক্ষোভ জমেছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালীর কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।

শ্রমজীবী মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার। প্রতিটি ভোগ্যপণ্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যাদের কিছু সঞ্চয় আছে তাও তারা ভেঙ্গে ফেলছে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। কোনো কোনো পণ্যের সরবরাহ বাজারে প্রচুর দেখা গেলে দাম কমছে না। এটা বাজার ব্যবস্থাপনার বড় সমস্যা। কিছু কিছু পণ্যের দাম সরকার বেঁধে দেওয়ার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের অজুহাতের শেষ নেই। একেক সময় একেক অজুহাত দাঁড় করায়। এ চিত্র বদলাতে হবে। সাধারণ মানুষ ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হলে চলবে না। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভ্রাম্যমান আদালতকে জোরদার করতে হবে, প্রয়োজনে সংখ্যা বাড়াতে হবে। একটি দেশে সামগ্রিক উন্নয়নের মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নই মুখ্য। একটি দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা ঝুঁকি প্রকট আকার ধারণ করে।

আমরা জানি, বিশ্বের বাজারে পণ্যের দামের হ্রাসবৃদ্ধির প্রভাব আমাদের দেশের বাজারেও পড়বে- এটাই স্বাভাবিক। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদের দেশেও পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে কিন্তু আমাদের দেশে তাৎক্ষনিকভাবে দাম কমে না। আবার যদিও কখনো কমে তা আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কমে না, অনেক কম হারে কমে। তবে এ কথাও ঠিক যে, আন্তর্জাতিক বাজারে যে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে তার প্রভাব আমাদের দেশে আসতে আসতে বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ার কথা অথচ আমাদের দেশে তা তাৎক্ষনিক বৃদ্ধি পায়, এ যেন অসাধু ব্যবসায়ীদের জাদুর কাঠির অপূর্ব ছোঁয়া, এ দেশের মানুষকে মুহুর্তেই মাটির পুতুলে পরিণত করছে। কিন্তু
বর্তমান সরকার এটি মানতে প্রস্তুত নয়। তাই সরকার এই অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। আর তখনই পণ্যটি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়। আমরা সাদা চোখে দেখতে পাই এ সংকট কৃত্রিম। এ হলো নানা কৌশলে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রতি বছর বিপুল অংকের টাকা লুটে নেওয়া। সে অসাধু ব্যবসায়ীরা থাকেও পর্দার আড়ালে, জাদুকরের ঝলমলে পোশাকের ভেতরে, চাইলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না কিংবা হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি, ডাল গুড়োদুধসহ অনেক পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাজারে সে হারে মুল্য কমেনি। অথচ কে না জানে আমাদের বাজার আমদানি নির্ভর। কিন্তু বিশ্ব বাজারের মুল্যবৃদ্ধি প্রক্রিয়া আমাদের বাজারে ক্রিয়া করে, মূল্য হ্রাস প্রক্রিয়া গোপনে চোখ বন্ধ করে থাকে আর যদি চোখ খোলে তো তা হয় রক্তচক্ষু।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মুল্য আগের তুলনায় অনেক কমেছে, তাতে কমেছে পরিবহন ব্যয়ও। ফলে আমদানি নির্ভর পণ্যের মূল্য অনেকাংশে কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের দেশে সে হারে কমেনি। এ এক আজব বিষয়ও বটে। এর কারণ হিসেবে কেউ কেউ ডলার সংকটকে দায়ী করছে। আসলে কি তাই? কে বলতে পারে তবে এ কথাও ঠিক যে বিশ্ব এখন চলছে এক অনাকাঙ্খিত মন্দার মধ্য দিয়ে। এটি শুরু হয়েছে করোনা কালীণ সংকটের ফলে। এক শ্রেণীর মানুষের আয় কমেছে, কমেছে ক্রয়ক্ষমতাও। এর সেেঙ্গ যুক্ত হয়েছে ডলার সংকট, রাশি- ইউক্রেন যুদ্ধ, গোদের ওপর বিষফোঁড়া মূল্যস্ফীতিও। অশুভ এ শক্তির মধ্যে কোনোটিই এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। তবে সচেতনতা প্রয়োজন, প্রয়োজন সতর্ক পদক্ষেপ। এসব কারণে যেন ভোক্তা সাধারনের ভোগান্তি না বাড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তা ছাড়া সব দিক বিবেচনা করে আমদানি নির্ভরতাও কমাতে হবে। স্বয়ং সম্পূর্ণ করে তুলতে হবে আমাদের উৎপাদনের হাত।

বিষয়টি দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থাও রাখতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করা এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এখন শুধু সময়ের দাবি।

নিত্যপণ্যের এই উর্ধ্বমুখিতা থেকে জনগণ মুক্তি চায়। তাই এর থেকে উত্তরনের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর সম্প্রসারণ করা, গরিব ও অসহায়দের স্বল্পমূল্যের খাদ্য বিতরণ এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো উচিত। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সর্বোপারি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর উর্ধ্বমুখী দাম যেন জনগণের সাধ্যের মধ্যে থাকে, সে দিকে নজর দেওয়া উচিত।

এভাবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ভেজাল প্রতিরোধ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জনদুর্ভোগ কমানো সম্ভব। দেশকে সোনার দেশে পরিণত করার জন্য এখনই শুরু করতে হবে এমন কাজটি।

লেখকঃ- কবি ও কলামিস্ট।

Ad