হাজীপুরে কৃষি জমি ও টিলার মাটি বিক্রির অভিযোগ। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা।

প্রকাশিত: ৬:০২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩

হাজীপুরে কৃষি জমি ও টিলার মাটি বিক্রির অভিযোগ। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা।
booked.net

 

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ-বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে বিতর্কিত কুলাউড়ার হাজীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ওদুদ বক্সের বিরুদ্ধে এবার কৃষি জমি খনন ও টিলা কেটে মনুনদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মাটি বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন ইউপি চেয়ারম্যান কে প্রধান আসামী করে কুলাউড়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন।

গত ৬ ফেব্রুয়ারি হাজীপুর ইউনিয়নের রনচাপ এলাকায় গেলে দেখা যায়, মাটি কেটে প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি থেমে নেই। চলছে মাটি কাটার মহোৎসব। স্থানীয়রা জানান, এ কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ওদুদ বক্স। এতে সংখ্যালঘু সহ ২৫ পরিবারের কৃষি ও তিন ফসলী জমি নষ্ট হয়ে জমির উর্বরতা হারাচ্ছে। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ কাজে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জমির মালিককে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে মাটি নেয়ার কথা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থদের অভিযোগ, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকদের সাথে যোগসাজশ করে ইউপি চেয়ারম্যান ওদুদ বক্স হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দাবি, নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য খাস জমি থেকে এলাকার উন্নয়নের জন্য তারা এসব মাটি কেটে বাঁধ উঁচু নির্মাণ করছেন। টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রশ্নই আসেনা।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, মাটি কাটার সাথে জড়িত ব্যক্তি ওদুদ বক্স হাজীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ায় সংখ্যালঘু পরিবারের নিরীহ লোকজন তাকে কিছু বলতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তিনি এলাকায় একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে পড়তে হয় নানা সমস্যায়।

এদিকে জোরপূর্বক মাটি কাটার অভিযোগ এনে ইউপি চেয়ারম্যান ওদুদ বক্স কে প্রধান আসামী, হাজীপুর ইউনিয়নের ইসমাইলপুর গ্রামের বাসিন্দা ধনাই মিয়ার ছেলে মখন মিয়া ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আরাধনা এন্টারপ্রাইজের মফিজুর রহমান জুয়েলের নামোল্লেখ করে গত ৩ ফেব্রুয়ারি কুলাউড়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা সুমিত রায়।

মামলার এজহার ও ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের রনচাপ গ্রামের মৃত সমরেশ রায়ের মালিকানা ক্ষেতের জমি খনন করে মাটি বিক্রি করছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ওদুদ বক্স। সরকারী কাজে ব্যবহার করার অজুহাত দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকায় এসব মাটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে তিনি বিক্রি করছেন। মাটি বিক্রির টাকাও তিনি তার পকেটস্থ করছেন। সমরেশ রায়ের ছেলে সুমিত রায় জানান, তাদের মালিকানাধীন অন্তত ১ একর ২০ শতক কৃষি জমি ও টিলার মাটি বিক্রি করা হয়েছে। ভেকু মেশিন দিয়ে খনন চলছে। মাটি কাটার কাজে বাধা দিলেও তা না মেনে পাল্টা হুমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে তাদের।

সুমিত রায় জানান, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটিতে চাকুরীর সুবাদে পরিবারের লোকজন নিয়ে তিনি সিলেটে বসবাস করেন। শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) তাদের মালিকানাধীন জমি থেকে ভেকু মেশিন দিয়ে জমি খনন ও টিলা কেটে ট্রাক যোগে মাটি বিক্রির খবর পান তিনি। সমিত রায়ের চাচাতো ভাই বরুন রায় স্থানীয়দেরকে সাথে নিয়ে মাটি কাটতে বাধা দেন। কিন্তু তাদের বাধা কেউ মানেনি। সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তারা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি। তারা আইনের আশ্রয় নিলেও চেয়ারম্যানের ভয়ে এখনও আতঙ্কে আছেন। তিনি জানান, এখনও জমি খনন ও টিলার মাটি কাটা হচ্ছে। পাশাপাশি টিলার অনেক গাছপালাও কেটে সাবাড় করা হয়েছে। এতে একদিকে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষেতের জমি নষ্ট হয়ে হারাচ্ছে উর্বরতা।

স্থানীয়রা জানান, চেয়ারম্যান ওদুদ বক্স এভাবে অন্তত ২৫ পরিবারের মানুষের কৃষি জমি খনন করে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাছে মাটি বিক্রি করেছেন। জমির মালিক বাধা দিলে তিনি তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখান। সংখ্যালঘু পরিবাবের লোক হওয়ায় চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না সুমিত রায়সহ ক্ষতির শিকার ২৫ পরিবারের লোকজন।

এদিকে জমির ক্ষতিপূরণ দাবিতে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত আবেদন করেছেন স্থানীয় রনচাপ এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র কুমার দাস ও মৃদুল দাস। যার অনুলিপি স্থানীয় সংসদ সদস্য, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে দেয়া হয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, হাজীপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের রনচাপ গ্রামের সুইচ গেইটের পশ্চিম দিকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার মনু নদীর বেড়ীবাঁধের দু’পাশে মাটি ভরাট করা হচ্ছে। উক্ত বাঁধের দু’পাশে তাদের প্রায় ৯০ শতক কৃষি জমি এবং বিভিন্ন প্রজাতির ২৫০টি গাছ উপড়ে ফেলা হয়েছে। কৃষি জমি থেকে বাঁধে মাটি দেওয়ায় জমিতে প্রায় ২০-২৫ ফুট গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। এই জমিতে আর কোন চাষাবাদ করা যাবে না। এতে তাদের প্রায় ছয় লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ধীরেন্দ্র কুমার দাসের। নির্মাণাধীন প্রতিরক্ষা বাঁধের পাশ থেকে কৃষি জমির মাটি অবাধে কাটার ফলে বাঁধের নিচে প্রায় ২০-২৫ ফুট গভীর গর্ত করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা বাঁধের পাশেই আরেকটি গভীর নদীর সৃষ্টি হয়েছে। মনু নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে সৃষ্ট গর্ত দিয়ে পানি প্রবেশ করে প্রথমেই ২৫টি পরিবারকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে “মনু নদীর ভাঙ্গন হতে” মৌলভীবাজার সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলা রক্ষা প্রকল্পের আওতায় মনু নদীর বামতীরে কিলোমিটার ১৫.০০০ হতে ২৪.৫০০ এর মধ্যবর্তী ৮৩৪০ মিটার ও কিলোমিটার ২৭.০০০ হতে ৩২.৮০০ এর মধ্যবর্তী ৪৪০০ মিটার ৪০টি র‌্যাম্পসহ (সিঁড়ি) বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ কাজ হাজীপুর ইউনিয়নের কটারকোনা থেকে রাজনগর উপজেলার তারাপাশা পর্যন্ত ১১ কোটি ৪৬ লাখ টাকায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স আরাধনা এন্টারপ্রাইজ। কাজ শুরু হয়েছে প্রায় মাস খানেক আগে। কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ৩০ জুন।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আরাধনা এন্টারপ্রাইজের মফিজুর রহমান জুয়েল জানান, কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েই জমি থেকে মাটি নেয়া হচ্ছে। আর সুমিত রায়ের জমিটি খাস থাকায় আমরা সেখান থেকে মাটি নিয়েছি। মাটি নেয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানকে কত টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চেয়ারম্যান কে তিনি কোন টাকা দেননি।

কাজের তদারকি কর্মকর্তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ পাবেল জানান, কোন অবস্থাতেই বাঁধের নিচ থেকে মাটি তোলা যাবে না। কাজের শিডিউল অনুযায়ী নিয়ম মেনে কাজ করতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মিনিমাম ৫ মিটার দূরত্ব থেকে মাটি কেটে আনতে হবে। কৃষকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি থেকে মাটি এনে বাঁধ তৈরি করতে হবে।

অভিযোগের বিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যান ওদুদ বক্স জানান, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলমান আছে। জমির মালিকদের আনীত অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টাকা লেনদেনের অভিযোগটি সঠিক নয়। কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ আব্দুছ ছালেক জানান, কৃষি জমি থেকে মাটি বিক্রির বিষয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামী করে থানায় একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের আলোচনা চলছে। তাছাড়া তদন্ত করে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জাবেদ ইকবাল জানান, বাঁধ তৈরিতে কৃষি জমি থেকে মাটি নিতে হলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জমির মালিকের সাথে চুক্তি করতে হবে। জমির মালিকের সম্মতিক্রমে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার পর মাটি নেয়ার কথা। কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মাটি নেয়া যাবে না। এছাড়া বাঁধের নিচ থেকে মাটি কাটার বিষয়টি সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা পেয়ে আপাতত কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Ad