শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র পেয়েছে টিআইবি।  

প্রকাশিত: ৭:০৮ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২১

শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র পেয়েছে  টিআইবি।  
booked.net

 

এনামূল হক,ঢাকাঃ- শিক্ষাখাতে মাধ্যমিক পর্যায়ে গবেষণা চালিয়ে সরকারি-বেসরকারি’র ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের চিত্র পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টান্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি দাবি করেছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি স্কুলে পদ ভেদে শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করা হয়। আর এই অর্থ নিয়ে থাকে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় গভর্নিং বডি’র সদস্যরা পর্যন্ত।

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা পত্র তুলে ধরে এমনটি দাবি করছে টিআইবি। এ সময় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান সহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।গবেষণায় বলা হয়, কেবল শিক্ষক নিয়োগ নয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক বদলিতেও নিয়ম বর্হিভূত অর্থের লেনদেন হয়।

অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা, এনটিআরসিএ কর্তৃক সুপারিশকৃতদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা, সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে ২ থেকে ৩ লাখ, শিক্ষক এমপিওভূক্ত ৫ হাজার থেকে ১ লাখ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষায় ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা, পাঠদান অনুমোদন ১ থেকে ৫ লাখ টাকা, স্বীকৃতি নবায়ন ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং শিক্ষক বদলীতে ১ থেকে ২ লাখ টাকা আদায় করা হয়।

গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে টিআইবি বলছে, মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার বা মানোন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ রয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ এই খাতের প্রত্যাশিত উৎকর্ষ অর্জনে এখনও ঘাটতি আছে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি হলেও এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়িত হয়নি। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও নীতিগতভাবে প্রাধান্য না পাওয়ায় শিক্ষা আইনটি এখন পর্যন্ত পাস হয়নি।

জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নয় এবং জাতীয় বাজেটে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ টাকার অংকে ক্রমান্বয়ে বাড়লেও শতাংশের ক্ষেত্রে এটি গড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। শিক্ষক ও কর্মচারীর জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অনুপস্থিতি রয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সমন্বিত জনবল কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং জনবল সক্ষমতার ঘাটতিতে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শনের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপের ঘাটতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিস্তার হচ্ছে; এবং শিক্ষা কার্যক্রম প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ অব্যাহত রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে।

সার্বিকভাবে মাধ্যমিক শিক্ষার কার্যক্রম বাস্তবায়নে আইনের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান রয়েছে।

এদিকে গবেষণার ভিত্তিতে বেশকিছু সুপারিশ করেছে টিআইবি। যা নিম্নরূপ-

১. শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

২. মাঠ পর্যায়ে সরাসরি রাজস্বখাতের আওতাভুক্ত সমন্বিত জনবল কাঠামো তৈরি করতে হবে।

৩. বয়স অনুযায়ী যে সকল শিক্ষার্থীর জন্য কোভিড-১৯ টিকা প্রযোজ্য তাদের দ্রুত টিকার আওতায় আনতে হবে। অনলাইনে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনা, শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি পূরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৪. ইউনেস্কোর সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

৫. এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে বৃদ্ধি করতে হবে। দ্রুত অবসর ভাতা প্রদানে বাজেটে বরাদ্দ রাখা এবং নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের অধিকতর দক্ষ করে তুলতে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতে বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়োজনীয় অর্থ ও অন্যান্য বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকৃত ল্যাপটপ, প্রজেক্টরসহ অন্যান্য উপকরণ রক্ষণাবেক্ষণে প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুকূলে আর্থিক বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।

৭. উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খসড়া নিয়োগবিধি দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে।

৮. বেসরকারি সকল নিয়োগ এনটিআরসিএ/বেসরকারি শিক্ষক নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।

৯. শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিতে পদক্রম বৃদ্ধি করতে হবে।

১০. প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণকালীন প্রশিক্ষণের ওপর কার্যকর মূল্যায়নে নিবিড় পরিবীক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

১১. প্রশিক্ষণের ওপর পরিপূর্ণ দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনে প্রদেয় প্রশিক্ষণের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে হবে।

১২. সকল ধরনের ক্রয় ই-জিপির মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।

১৩. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকৃত আইসিটি উপকরণের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণে একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার থাকতে হবে।

১৪. সরকারিভাবে/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ পর্যায়ক্রমে স্থায়ী মাল্টিমিডিয়ার আওতায় আনতে হবে।

১৫. দরপত্র, কার্যাদেশ, প্রকল্পের ক্রয় ও নিরীক্ষা সংক্রান্ত সকল হালনাগাদ তথ্য সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।

১৬. মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশান উইংয়ের প্রকাশিত বার্ষিক পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বিভিন্ন প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি এবং দুর্বলতার কারণসমূহ সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে।

১৭. এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বার্ষিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা থাকতে হবে।

১৮. শিক্ষক ও কর্মচারী এমপিওর অনলাইন সফটওয়্যারটি আরও সহজবোধ্য এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করতে হবে।

১৯. বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করতে হবে।

২০. বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে।

Ad