আজ রেল দিবস।

প্রকাশিত: ৬:৪৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১৫, ২০২২

আজ রেল দিবস।
booked.net

ডেস্কঃ- আজ ১৫ নভেম্বর, রেল দিবস। বাংলাদেশ রেলওয়ের ১৫৯ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গত বছরের এই দিনে রেল দিবস পালন করা হয়েছে। আজ দেশে তৃতীয়য়বারের মতো দিবসটি পালন করা হবে‌।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর প্রথম চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত ৫৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ চালু করা হয়। তারপর বিভিন্ন ধরনের ঘাত-প্রতিঘাত মাড়িয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে এগিয়ে যায়।

🔴 বাংলাদেশ ভূখন্ডে রেলওয়ের আগমন-
আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম সুনির্দিষ্ট রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ১৮৫২ সালে। ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল জে পি কেনেডি তার সামরিক সুবিধা বিবেচনায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে গঙ্গা নদীর পূর্ব তীর ধরে সুন্দরবন হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথ বসানোর প্রস্তাব দেন। তার এই প্রস্তাব ব্রিটিশ সরকার বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই গ্রহণ করে। কিন্তু এরই মধ্যে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশ সরকার মিয়ানমার (তৎকালীন বার্মা) দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল মিয়ানমারকে ভারতীয় উপনিবেশের সাথে সংযুক্ত করতে। রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সুবিধার কারণে মিয়ানমারের রাজধানী রেঙ্গুন থেকে কলকাতা পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের প্রশ্ন তখন প্রকট হয়ে ওঠে। চাপা পড়ে যায় কর্নেল কেনেডির দেয়া প্রস্তাব।

১৮৫৫ সালে বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল কোরের মেজর অ্যাবার ক্রমবি মাঠ পর্যায়ের একটি জরিপ পরিচালনা করেন। এতে তিনি ভূপ্রকৃতি যাচাই, রেলপথ নির্মাণের সম্ভব্য খরচ, বাণিজ্যিক সুবিধাদি ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তাছাড়া পর্যবেক্ষণে রাখা হয় সামরিক সুবিধাদিও। এই পর্যবেক্ষণানুযায়ী তিনি একটি রিপোর্ট পেশ করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। ব্রিটিশ সরকার তার এই প্রস্তাবনা এবং প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে বাংলায় রেলপথ স্থাপন করা হবে। এতে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামে একটি রেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা উল্লেখ করা হয়। অনেক যাচাই-বাছাই এবং সমীক্ষার জটিলতা শেষ হতেই দু’বছর কেটে যায়। অবশেষে ১৮৫৭ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। ব্রিটিশ প্রবীণ রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ওয়েলিংটন পার্ডান-এর তত্ত্বাবধানে বাস্তবে রূপ নেয় এই প্রকল্পটি।

🔴 কলকাতা- রানাঘাট-জগতী রেল সেকশন-
ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার পর তাদের সর্বপ্রথম সফল কাজ ছিল কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেল সেকশন উন্মোচন। ১৮৫৮ সালের ৩০ জুলাই কলকাতার হুগলি নদীর পূর্ব পাড় থেকে (বর্তমানে শিয়ালদহ স্টেশন) রানাঘাট, দর্শনা, পোড়াদহ হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি (বর্তমান বাংলাদেশ) পর্যন্ত একটি ব্রডগেজ (৫ ফুট ৬ ইঞ্চি) রেলপথ নির্মাণের জন্য ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রস্তাবিত এ লাইনের দৈর্ঘ্য ছিল ১১০ মাইল। প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল তৎকালীন ১ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং।

এর মধ্যেই ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গেল সিপাহী বিদ্রোহ। সে কারণে রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম কিছুটা থমকে যায়। অবশেষে বিদ্রোহের অবসান ঘটলে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি পুরোদমে কাজ শুরু করে দেয়। ভূমির সম্ভাব্যতা যাচাই এবং জমি অধিগ্রহণ শেষে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। ইস্টান বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি রেলপথ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করে। এতে করে মেসার্স ব্রেসী ও পেক্স অ্যান্ড ওয়াইটেস নামক দুটি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা কলকাতা আসেন। শুরু হয়ে যায় এক এলাহী কর্মযজ্ঞ।

প্রস্তাবিত এই ১১০ মাইল লাইন নির্মাণের অংশ হিসেবে কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যায় আগেই। সেসময় অবশ্য জগতি পর্যন্ত লাইন নির্মাণের কার্যক্রমও চলমান ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তাদের ব্যবসায়িক সুবিধা বিবেচনায় সম্পূর্ণ লাইন নির্মাণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলেন না। নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ায় কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত সেকশনে ট্রেন চলাচল শুরু করতে চাইল। অবস্থা তখন এমন হয়েছিল যে তারা যেন আর একটি দিনও অপেক্ষা করতে পারবে না।

১৮৬২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে রানাঘাট সেকশনটি উদ্বোধন করা হয়। এই সেকশন দিয়ে সেদিন থেকেই ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে যায়। তার কয়েক মাসের মধ্যেই রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজও সমাপ্ত হয়। ফলে সেবছরই ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর রানাঘাট থেকে দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ উন্মোচন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রেন চলাচলের মাধ্যমে রেল পরিষেবার সূচনা ঘটে আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। এই রেলপথের শেষ স্টেশন জগতিকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন। যদিও এই সেকশনে জগতি ছাড়াও পোড়াদহ, চুয়াডাঙ্গা এবং দর্শনাও একই দিনে উদ্বোধন করা হয়।

নদীবিধৌত পূর্ববঙ্গের নরম মাটি বাষ্প-শকটের সদম্ভ পদভারে প্রকম্পিত হতে লাগল। অবহেলিত বাঙালিরা তাকিয়ে থাকল নতুন যুগের এই বার্তাবাহকের দিকে। দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলায় খাদ্য নিরাপত্তা অনেকটা সুসংহত হলো। অন্যদিকে আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল ব্রিটিশ শাসনের নিগড়। প্রথম যেদিন ট্রেন এলো পূর্ব বাংলায়, একরাশ ভয় ও বিস্ময় গ্রাস করল বাঙালিকে। কারণ ইতিপূর্বে বাঙালি ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে চলা বাষ্প-শকট চালিত এই গতিদানব দেখা তো দূরের কথা, এমন যান যে পৃথিবীতে আছে তা কল্পনাও করতে পারেনি।

কয়লা পুড়িয়ে ধোয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝকঝকে রব তুলে যখন জগতি স্টেশনে ট্রেন এসে থামত, তখন রেলগাড়ি দেখার একরাশ কৌতূহল নিয়ে আশপাশের এলাকায় অগণিত মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। কয়লার ট্রেন থেকে হয়েছে ডিজেল চালিত ট্রেন, ডিজেল থেকে হয়েছে বৈদ্যুতিক ট্রেন- কত কিছুই পরিবর্তন ঘটেছে কালের পরিক্রমায়, কিন্তু মানুষের মধ্যে রেলগাড়ির সেই কৌতূহল যেন আজও শেষ হয়ে যায়নি।

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ থেকেই নীল চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল কুষ্টিয়া। নীলচাষী ও নীলকরদের আগমনের পরই কুষ্টিয়ার নগরায়ন শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া বস্ত্র শিল্পের জন্য কুষ্টিয়া বরাবরই বিখ্যাত ছিল। সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে এখানে একটি নদী বন্দর স্থাপিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই বন্দরটি ব্যবহার করত। বিশেষত নীলকররা এবং নীল ব্যবসায়ীদের দখলে থাকতো এই বন্দরটি। কুষ্টিয়া ছিল নদীয়া জেলার একটি মহাকুমা। পরে কোম্পানি শাসনামলে এটি যশোর জেলার অধীনে চলে আসে। রেল যোগাযোগ স্থাপনের পর অত্রাঞ্চলে নগরায়নের সুবাতাস বইতে থাকে। তারই রেশ ধরে ১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়া পৌরসভা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

একটা প্রযুক্তি পুরো একটা সমাজকে বদলে দেবে”, কার্ল মার্ক্সের সেই ভবিষ্যদ্বাণী বিফলে যায়নি। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাকা সচল হতে শুরু করে। কুষ্টিয়ায় স্থাপিত হতে থাকে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আনাগোনা দেখা দেয় ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের। ১৯০৮ সালে কুষ্টিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মোহিনী মিল’ যা ছিল তৎকালীন সময়ে সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় কাপড়ের কারখানা। তাছাড়া ১৮৯৬ সালে যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস রেনউইক এবং ১৯০৪ সালে যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং নামে দুটি শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর দর্শনায় প্রতিষ্ঠিত হয় ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘কেরু এন্ড কোং’। এটি ছিল ঐ অঞ্চলের মধ্যে তৎকালীন সবচেয়ে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। এভাবেই শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে এ অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে।

Ad