প্রকাশিত: ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ, মে ১, ২০২১
আচ্ছালামুআলাইাকুম, শুভেচ্ছা প্রিয় পাঠক- আজকের লেখার শিরোনাম দিয়েছি, “অবশেষে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা! শরীয়ত চলে ডালে ডালে আইন চলে পাতায় পাতায়!” এরকম শিরোনাম দেয়ার পিছনে একটি কারণ আছে, তা এলেখাটি পড়ার শেষে আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন আশা করি।
আপনারা ইতিমধ্যে সবাই জেনেছেন যে, মৌঃ মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তার ২য়-স্ত্রী অবশেষে একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের করেছেন। এই মামলার কার্যধারা সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই। শুধু সংশ্লিষ্ট আইন বিষয়ে আমাদের সচেনতা বৃদ্ধি বা জানার জন্য এই লেখা। আর এখানে উদাহরণ হিসাবে আমি এ মামলাটি নিয়েছি।
তাহলে আমরা দেখি, মৌঃ মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা কীভাবে চলে আর কীভাবে চলেনা এবং বহুবিবাহ বিষয়ে শরীয়াহ এবং প্রচলিত আইনের কী ফাঁকফোকর আছে তা একটু দেখে নেবো এবং এর জন্য আমাদেরকে দেখতে হবে শরীয়াহ আইন এবং প্রচলিত কিছু আইনের কয়েকটি ধারা। এখানে আমি এগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করছি যাতে বিষয়টি আমাদের কাছে একটু পরিস্কার হয় আবার একটু প্যাঁচও লাগে। আপনাদের যাঁদের ভাল লাগে লেখাটি পড়–ন আর যাঁদের ভাল লাগছেনা আপনারা এখানেই শেষ করতে পারেন। যাঁরা পড়ছেন বা যাঁরা শেষ করছেন, দুই পক্ষকেই ধন্যবাদ। যাঁরা সাথে আছেন চলুন বিষয়টা নিয়ে এগিয়ে যাই।
প্রথমে আমি শরীয়াহ’র দিকে নজর দিবো। মুসলিম ধর্মের বিধিবিধান থেকে শরীয়তের উৎপত্তি। মুসলিম ধর্মের বিধিবিধান দিয়েছেন মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে এবং তা প্রেরণ করেন তাঁর রাসুল মোহাম্মদ (সঃ) কাছে এবং তা বিশ্বাস করার জন্য তিনি আহ্বান জানান দুনিয়ার মনুষ্যজতগকে। শরীয়াহ আইনানুযায়ী বা ইসলামধর্মের বিধানমতে আরোপিত শর্তপালন করে একটি মুসলিম বিবাহ সম্পাদন হলে তা বৈধ হয় বলেই আমরা সবাই জানি। এখানে বিবাহটি রেজিষ্ট্রির কোনো বিধান নেই। নিকাহ রেজিস্ট্রি ছাড়াই বিয়েটি বৈধ হবে।
অন্যদিকে একজন মুসলিম পুরুষ ইচ্ছে করলেই এক থেকে চারটি বিয়ে করতে পারেন, বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের অনুমতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই, এমর্মে এবিষয়টি শরীয়াহ আমাদেরকে বহুবিবাহের একটি স্পষ্ট ধারনা দিয়েছে। এটা আমরা সবাই জানি বা জানানো হয়েছে। তবে পবিত্র কোরআনের ভাষ্যানুযায়ী এর ভিন্ন প্রেক্ষাপট আছে তা আমাদেরকে স্পষ্ট করে শরীয়াহআইন জানায়নি বলে সংশ্লিষ্ট বুজুর্গগণও আমাদেরকে তা জানতে দেননি বা জানান নি। এ আলোচনার প্রসঙ্গ ভিন্ন তাই এদিকে এগুচ্ছিনা। তাহলে শরীয়াহ আইনে মোটমুটি বুঝা গেলো মামুনুল হক সাহেবের কোনো অপরাধ নাই।
এবার আমরা রাষ্ট্রীয় প্রচলিত আইনের দিকে নজর দেবো, দেখি ওখানে কি বলা আছে। আপনারা জানেন মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১ নামে একটি আইন বাংলাদেশে চালু আছে। এবার আসুন মুসলিম পারিবারিক আইনের সংশোধিত সংশ্লিষ্ট ধারাটি পড়ি। এ আইনের ৬নং ধারায় বহুবিবাহ (ইংরেজিতে যা ‘পলিগ্যামি’) সম্পর্কে বলা হয়েছে। উপধারা ১এর ভাষ্য হলো, কোনো ব্যক্তিই বর্তমান বিবাহ বিদ্যমান থাকাকালীন সালিসী পরিষদের লিখিত পূর্বানুমতি ব্যতীত আরেকটি বিবাহ করতে পারবেনা এবং যদি করেও ঐ বিবাহটি ১৯৭৪সনের নিকাহ নিবন্ধন আইনে নিবন্ধন করা যাবেনা। এটা আমরা জানি।
উপধারা ৫এর ‘ক’-তে বলা আছে- পূর্বের স্ত্রী বা স্ত্রীগণের মোহর বাবদ কোনো পাওনা বকেয়া থাকলে তিনি তা পরিশোধ করে দিবেন, নচেৎ সরকারী দাবী আদায় আইনানুযায়ী তা আদায় করা হবে। ‘খ’-তে বলা আছে, সালিস পরিষদ তথা বিদ্যমান স্ত্রী বা স্ত্রীগণের অনুমতি ছাড়া অন্য বিয়ে করার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তা একটি অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং তার জন্য তিনি একবৎসর পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য বিনাশ্রম কারাবাস বা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত বর্ধণযোগ্য জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এখানে ‘বর্ধনযোগ্য’ শব্দটি মামলার বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত। এ আলোচনা ভিন্ন।
এখানে বুঝা গেলো, বিবাহ বিষয়ে মামুনুল হক যে অপরাধ করেছেন তা এ ধারার আওতায় পড়ে এবং শাস্তিও এখানে বলা আছে। যেহেতু, বর্তামান আলোচ্য বাদিনীর এ ধারায় প্রতিকার থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন ধর্ষণের দিকে আঙ্গুল তুললেন তা অবশ্যই উদ্দেশ্য প্রণোদিতই বলেই মনে হয়।
মুসলিম বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয় মর্মে ৪ এমএলআর (এডি) ১১৩-১১৪ রিপোর্টেড একটি মামলায় মহামান্য সবোর্চ্চ আদালত বলেন- অত্র অধ্যাদেশের ধারা ৬ এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ; কিংবা বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবেনা। তবে অত্র ধারাটি আইন ভঙ্গের জন্য শাস্তির বিধান করেছে।
এখন আমরা দেখবো ১৯৭৪সনের নিকাহ রেজিষ্ট্রি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি। উক্ত আইনের ৫ধারায় বলা হয়েছে, নিকাহ রেজিস্ট্রার ব্যতীত অন্য যে ব্যক্তি বিবাহ পড়ান তিনি বিবাহটি রেজিস্ট্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কাজি অফিসে প্রতিবেদন দাখিল করবেন। কিন্তু তিনি এ বিধান লঙঘন করলে তিনমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা পাঁচশত টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। অতঃপর ২০০৫ইং সনে উক্ত আইন সংশোধনের মাধ্যমে বলা হয়েছে, বিাবাহ সম্পাদনের তারিখে বা সম্পাদনের তারিখ হতে ৩০দিনের মধ্যে বিবাহের পাত্র(স্বামী) অবশ্যই বিবাহটি সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিষ্ট্রার অফিসে বিবাহটি রেজিষ্ট্রি করাবেন। এ বিধান লংঘন করলে আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি দুই বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড অথবা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে।
তবে এ আইনেও বিবাহটি রেজিস্ট্রি না করার জন্য মামুনুল হক শাস্তি পাবেন। কিন্তু সত্যিই যদি শরীয়তের সম্পূর্ণ বিধান পালন করে তিনি বিয়েটি করে থাকেন তবে বিবাহটি বাতিল হবেনা। তাই এখানে ধর্ষণের মামলা আইনতঃ চলেনা। কারণ, উ্পরের যে বিধানগুলো বর্ণনা করলাম, এগুলো সাধুসন্যাসী মানুষের জন্য। যাঁরা সত্য গোপণ করেন না এবং মিথার আশ্রয় নেন না। সত্য ঘটনার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকতে চান, কেবল তাঁদের জন্য।
কিন্তু যারা বাঁকা পথ চান, কাউকে শায়েস্তা করতে চান তাদের জন্য্ও আইন দু’চারটি প্যাঁচ লাগাইন্যা শব্দ বা বাক্য বা বিধান রেখেছে। যাদ্বারা উপরের সব কথা বাদ হয়ে যাবে! সব বিধান হবে নস্যাৎ! আর তা এখন বলছি- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ অতঃপর সর্বশেষ সংশোধনী ২০২০ এর ৯(১) ধারায় ধর্ষনের সংজ্ঞায় বলা আছে, “যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সী কোনো নারীর সহিত তার সম্মতিসহ বা ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।”
ধর্ষণের এই সংজ্ঞায় আমাদের কোনো আপত্তি নাই। এখানে “ভীতি প্রদর্শন” বা “প্রতারনামূলকভাবে” সম্মতি আদায়ের বিষয়ে যে শব্দদুটি ব্যবহার করা হয়েছে, এই শব্দ দুটির স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকার কারণে দুষ্ট লোকেরা এই শব্দদুটির উপর ভর করে ঘটনার বাস্তবতা যা কিছু ভিন্ন থাকুক না কেন, একটি ধর্ষনের মামলা রূজু করার সুযোগ পেয়েছে। আমরা মনে করি, যাদের বয়স আঠারো বৎসরের উপরে আইন তাদেরকে সাবালক অর্থাৎ মেজর বলেছে এবং তাদের আইনসঙ্গতভাবে ভালমন্দ বুঝার বয়স হয়েছে। তারা অবশ্যই কোনোটা ‘প্রলোভন’ বা ‘প্ররোচনা’ আর কোনটা ‘প্রতারনা’ বুঝেন। তারপরও সুযোগ পেলেই না বুঝার ভান করেন। এ বিষয়গুলোকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ ধর্ষনের আলোচ্য সংজ্ঞায় পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করা থাকলে ভাল হতো, মিথ্যা মামলার ভার থেকে মানুষ ও আদালত অনেকটা রেহাই পেতো।
আলোচ্য ধর্ষনের সংজ্ঞার প্রথম লাইনে বলা আছে “বিবাহ বন্ধন ব্যতীত” কথাটি। কিন্তু মামুনুল হকের ঘটনায় শরীয়াতসম্মত বিবাহের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যম আমাদের সম্মুখে এনেছে এবং ঐ সময়ে লাইভে এসেও বাদিনী শরীয়তসম্মত বিবাহ হয়েছে এরকমই একটি ইঙ্গিত স্বীকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বিধি বাম! এ আলোচনার প্রেক্ষিতে মামনুল হকের বিরুদ্ধে তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী অত্রবাদিনীর আনীত ধর্ষণের মামলাটি আমাদের মনে অনেক প্রশ্নের খোরাকের যোগান দেয়। আর এবিষয়গুলো ব্যক্তি কেন্দ্রিক। কিন্তু ইসলাম ধর্মের একজন প্রসিদ্ধ নেতা হিসাবে মামুনুল হক বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে যে ঘটনার জন্ম দিয়েছেন, আমি একজন মুসলিম হিসাবে তার নিন্দা অবশ্যই করতে পারি। একই সাথে ধর্ষনের মত কঠোর শাস্তির মামলায় পড়ে যাওয়াটাকে বাস্তবতার আলোকে আমাদের কাছে কেমন যেনো বেমানান লাগছে বা মনে হয়।
অন্যদিকে হেফাজতইসলামের ব্যানারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধমূকল কৃত কার্যাবলীর আনীত অভিযোগের আলোকে মামুনুল হকের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অবশ্যই সেটার বিচার হোক দেশের নাগরিক হিসাবে এটাও আমাদেরও কাম্য।
এতক্ষণে আমার আলোচনার প্রেক্ষিতে অত্র আলোচনার শিরোনামের কথাগুলোর অর্থ নিশ্চয়ই আপনারা খূঁজে পেয়েছেন আশা করি। সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকুন।
লেখকঃ এড্ মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম
বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট।
Published From
Positive International Inc,
73-16, Roosevelt Ave Floor 2, Jackson Heights, New York 11372.
Email : voiceofkulaura2@gmail.com
Chief Editor : Shafiq Chowdhury
Editor : Abdul Quayyum
Managing Editor : Nurul Islam Emon
Design and developed by positiveit.us