বই চুরি প্রসঙ্গে…

প্রকাশিত: ৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১

বই চুরি প্রসঙ্গে…
booked.net

বই চুরি কী অপরাধ? সে কী অন্য সব চুরির মতোই নিন্দিত? আর অপরাধ হলে তার শাস্তি কী? কোথায় লিখা আছে বিধি-বিধান? লেখক কিংবা পাঠক জীবনের সাথে ‘বই চুরি’ শব্দ যুগল জড়িয়ে থাকে ওতোপ্রতোভাবে। কেউ বিষয়টিকে দেখেন অপরাধ হিসেবে,কেউবা আবার নানা যুক্তি ঠেসে দেন। পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকেরাও মুক্ত নন ‘বই চুরি’র অভ্যাস থেকে। কেউ কেউ এটাকে আবার ‘আর্ট’ হিসেবেও অভিহিত করেন। তবে সব বই চোরদেরই সরল বিশ্বাস, এটা কোনো পাপ নয়। ইতিহাসে বই লুঠ কিংবা চুরির অনেক বড়ো বড়ো ঘটনাও ঘটেছে। আলবের্তো মাঙ্গোয়েল এর ‘আ হিস্ট্রি অব রিডিং’ বইয়ে বিখ্যাত পন্ডিত কাউন্ট লিব্রি এর বই চুরির রোমাঞ্চকর তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়াও প্রাচীন রোমের অনেক গ্রন্থ নাকি ছিল গ্রীস থেকে লুঠ করে আনা। আবার ইংরেজ কতৃক ভারত থেকে অনেক মহামূল্যবান বই লুঠ করে নিয়ে যাওয়ার কথাও ইতিহাসে প্রচলিত।
.
মার্কিন এক বিখ্যাত বই চোর-স্টেফান ব্লুমবার্গ এর কথা হয়তো অনেকেরই জানা। এই বই চোর তিরিশ বছর ধরে বই চুরি করে প্রায় তেইশ হাজার বই-এর মালিক হয়ে উঠেছিলেন। স্টেফানের চুরি করা বইগুলির সর্বমোট মূল্য দাঁড়িয়েছিল প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডলার। তবে স্টেফান তাঁর চুরি করা বইগুলো বিক্রি করতে আগ্রহী ছিল না, সে মনোযোগী ছিল বই পড়তে, বিচিত্র জ্ঞানের স্বাদ নিতে। সে বই চুরি করত, বই সযত্নে রাখত এবং পড়ত। চুরির পেছনে তাঁর যুক্তি ছিল- সে মূল্যবান বইগুলিকে নিজের কাছে রেখে মূলত বইগুলিকে বাঁচিয়ে রাখছে এবং সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই নাকি সে এ কাজ করেছে। বলুন তো, স্টেফান ব্লুমবার্গকে কি বই চোর বলা যায় নাকি অন্য কোনো অভিধায় আখ্যা দেয়া যায়?
.
আবার ব্রিটিশ নাগরিক উইলিয়াম জেকস কে বই চুরির অপরাধে দু’বার জেলও খাটতে হয়েছে। ব্রিটেনের সব বিখ্যাত লাইব্রেরিতে সে বই চুরি করেছে যার মূল্য ছিল প্রায় ১৫০ মিলিয়ন পাউন্ড।
.
তবে চুরি করে এনে সে বই বাজারে বিক্রি করে দেয়া অবশ্যই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। পৃথিবীর নানা জায়গায় এমন মাফিয়া সিন্ডিকেট রয়েছে যারা দুস্পাপ্য বই গুলো নানা কায়দায় সংগ্রহ করে থাকে এবং সময়ে সময়ে বাজার মাত করে।
.
একটু হৃদয় খুলে তাকালে ‘বই চোর’ বিষয়টির সঙ্গে সাম্প্রতিককালের আলোচিত বুক থিফ বইটির প্রসঙ্গ তুলে আনা যায়। অসাধারন এ উপন্যাসটির লেখক মারকুস্ জুসাক। ২০০৫ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। ‘বুক থিফ’- বইটি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর নিপীড়ন,নির্যাতন আর ধ্বংসলীলায় জনমনে যে ত্রাসের সৃষ্টি করে, সেই সময়কার একটি ঘটনাকে উপজিব্য করে। উপন্যাসে আমরা দেখা পাই লিসেল নামে এক কিশোরীর। পরিচিত হই তার উদ্বেগতাড়িত অসহনীয় ভয়াবহ জীবনযাপনের সঙ্গে, যখন সে তার ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিষন্ন,বিপন্ন জীবন নিয়েও সে চালিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন দেখা। সেই তুমুল প্রতিকুল সময়ে মেয়েটি বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। ভাইয়ের কবর খননকারীর পকেট থেকে পড়ে যাওয়া বই, দ্য গ্রেভডিগারস্ হ্যান্ডবুক টি চুপিসারে তুলে নেয়ার মাধ্যমেই তার বই চুরি শুরু। পালক পিতা তাঁকে শেখাতেন শব্দ। লিসেল আসক্ত হতে থাকে বইয়ের প্রতি। নাৎসি বাহিনীর ধ্বংস স্তুপ থেকে কুঁড়াতে থাকে বই। এভাবে সে পরিণত হয় একজন ‘বই চোর’-এ । তবে তার বই চুরির উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। তার লক্ষ্য ছিল নাৎসি সৈন্যরা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে এমন বই চুরি করে লুকিয়ে রাখা, যাতে সেগুলো তারা ধ্বংস করতে না পারে। লিসেলের মতো ‘বই চোরেরা’ আমাদের সভ্যতার আলোকবর্তিকা।
.
এসবের বাইরে বই ধার দিয়ে ফেরত না পাওয়ার মতো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পাঠক জীবনের সাথে বন্ধুর বই, স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারের বই, পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নেয়া বই সচেতনভাবে ফেরত না দেয়ার ঘটনা তো অহরহই ঘটছে। চুরি এড়াতে একসময় বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় নানা রকম সর্তকতামূলক কথা লিখে রাখার প্রচলন ছিল। ইদানীংকালে অনেকেই ব্যাক্তিগত পাঠাগারে ‘দয়া করে বই ধার দিতে বলবেন না’-কথাটি লিখে রাখেন। আবার বইমেলা থেকে বই চুরির ঘটনা অহরহই ঘটে। কখনো কখনো ধরা পড়লেও এ নিয়ে খুব হইচই চোখে পড়ে না। তবে কলকাতায় একবার বই চুরির অপরাধে এক ব্যক্তিকে বই নিয়ে একটি ‘প্রবন্ধ লেখা’র শাস্তি দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। আবার ‘বই চুরি’কে বিশেষ প্রেক্ষাপটে সমর্থনও করেছেন অনেকে। লেখক-চিন্তক অধ্যাপক যতীন সরকার তাঁর প্রবন্ধে বলেন, “কিছু কিছু ধনবান যখন তার উন্নত রুচির প্রমাণ প্রদর্শনের জন্য শেলফে বই সাজিয়ে রাখে,কিংবা নিতান্ত খেয়ালের বশে দু’চারটা বই কিনে ফেলে অথচ সে-সব বই নিজেও পড়ে না এবং অন্যকেও পড়তে দেয় না,তখন ধনহীন জ্ঞানবানদের দায়িত্বই হয়ে যায় জ্ঞানহীন ধনবানের কবজা থেকে বইগুলোকে বের করে আনা। এর জন্য প্রয়োজনে চৌর্যের আশ্রয় নেয়াটা মোটেই অবৈধ বা অসঙ্গত নয় বলেই আমার বিশ্বাস”। এভাবে বই চুরির পক্ষে বিপক্ষে নানা মত রয়েছে।
.
তবে যে যাই বলুক,জ্ঞান অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে বই চুরি এখনো তেমন অপরাধ হিসেবে কোথাও গণ্য হয় বলে জানা যায় নি। বিক্রি, মুনাফা, মাফিয়াগিরি সেসব অন্য বিষয়।

লেখকঃ- প্রনব কান্তি দেব।সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Ad