প্রকাশিত: ৯:১৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ২, ২০২১
আজকে আমরা দেখবো- ধর্মনিরপেক্ষতা কি এবং এর প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট; ধর্মনিরপেক্ষতা কেন প্রয়োজন; সার্বজনীনভাবে আইনে ধর্মনিরপেক্ষতার অবস্থান কোথায়; ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমরা সমর্থন করি কিনা?
সেক্যুলার কিংবা সেক্যুলারিজম শব্দের ঘ্রাণ আমাদের কাছে স্পর্শকাতর! অথচ এগুলোর অর্থ একেবারেই সরল। প্রায় সকলেরই জানা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান তিনটি বৈশিষ্টের কথা বলছি। আশা করি ভূল স্বাদ বা ঘ্রান নেয়া থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদেরকে সাহেয্য করবে। প্রথমে, শব্দটির অর্থ একবার স্মরণ করে নেই-
আমরা জানি, সেক্যুলার শব্দের অর্থ “ধর্মনিরপেক্ষতা” এবং সেক্যুলারিজম অর্থ “ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ”। যাঁরা এ মতবাদে বিশ্বাস করেন, তাঁদেরকে বলা হয় ‘সেক্যুলারিস্ট’ বা ‘সেক্যুলারবাদি’। অনেকে অতি আগ্রহী হয়ে নিরপেক্ষতাবাদকে নাস্তিকতার তকমাও লাগিয়ে দেন।
আরো পড়ুনঃ সাংবাদিকতার তথ্য সংগ্রহ করা চৌর্য্যবৃত্তি নাকি পেশাবৃত্তি
ধর্মনিরপেক্ষতা কি নাস্তিকতা? এবিষয়টির ফায়সালা পাঠকের হাতেই থাকলো।
এখন আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট দেখে নেই-
১। এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষের উপর বল বা শক্তি প্রয়োগ করবেনা। যেমন- কেউ বলবে না “এখন নামাজের সময়, তুমি পুজা পাঠ করতে পারবেনা”; কেউ বলবে না “আমাদের ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া নিষেধ, সুতরাং তোমরাও খেতে পারেনা; ইত্যাদি। এরকম বলার বা করার অধিকার কারো নেই। এক ধর্মের রীতিনীতির উপর অপর ধর্মের সহনশীলতা থাকতে হবে।
২। একই ধর্মের লোকেদের মধ্যে একদল লোক আরেক দলের উপর কোনো রকমের জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ করতে পারবেনা; যেমন- ব্রাম্মণ হিন্দু, সে শূদ্রের উপর বলপ্রয়োগ করতে পারবেনা। বলতে পারবেনা, “তুমি ছোট জাত, তোমার মন্দিরে যাওয়া নিষেধ”।
ধর্মনিরেপক্ষতা মানে কেবলমাত্র দুটো আলাদাআলাদা ধর্মের মধ্যে নয়। একই ধর্মের ভিন্নভিন্ন গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়ের মধ্যেও এটি প্রযোজ্য।
এক সম্প্রদায়ের লোক আরেক সম্প্রদায়ের লোকের উপর জবরদস্তি করবেনা, পারস্পারিক সহনশীলতা থাকতে হবে। যেমন, “তুমি কৃষ্ণের পুজো কর, আমি কালি পুজো করি; তুমি জোরে আমীন বল, আর আমি আস্তে আমীন বলি,” ইত্যাদি যেকোনো কিছু করতে কোনো সমস্যা নাই।
প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিচারিক বুদ্ধিমত্তাদ্বারা ধর্মীয় বিধিবিধানের শুদ্ধতা বুঝে নেবার অধিকারী।
৩। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষে বা প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা হস্তক্ষেপ কিংবা বৈষম্য প্রদর্শন করবেনা বা দেখাবে না এবং এমন কি রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তির স্বতন্ত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে কেড়ে নেবার চেষ্টাও করবেনা; অর্থাৎ যতক্ষণ না ধর্মীয় কোনো বিধিবিধান বা আচারানুষ্ঠান দ্বারা রাষ্ট্র বা দেশের সংবিধান কিংবা প্রচলিত আইন বা কোনো নাগরিকের কোনো আইনসঙ্গত অধিকার ক্ষুন্ন করা না হবে বা ফৌজদারী কোনো অপরাধ না করা হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র ধর্মীয় কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করবেনা ।
এটাও ধর্মনিরেপক্ষতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট । অর্থাৎ রাষ্ট্র বলতে পারবেনা দাড়ি, টুপি, হিজাব বা আখেল্লা পরা নিষিদ্ধ কিংবা কাউকে বলতে পারবেনা তুমি ধর্মান্তরিত হতে বা ধর্ম ত্যাগ করে নাস্তিক হতে পারবেনা প্রভৃতি।
আবার কোনো ধর্মীয় নেতা এগুলো পরার বা করার জন্য তাঁর বা অন্য কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোককে বাধ্য করতে পারবেনা। ফতোয়া দেয়া যাবে, তবে ফতোয়া দ্বারা কাউকে বাধ্য করা যাবেনা। কেউ এটি করতে গেলে রাষ্ট্র তাকে রাঁধা দেবার অধিকারী।
আরো বৈশিষ্ট আছে, তবে এই হলো প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট। যখন কোনো রাষ্ট্র ও তার নাগরিক এগুলোর সঠিক চর্চা করবে তখনই কেবল একটি দেশ আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গণ্য হবে।
কমবেশী প্রত্যেক ধর্মের বিধিবিধানে এই বৈশিষ্টগুলো আছে। ইসলামধর্মের পবিত্র কোরাণের “লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালইয়াদ্বীন” আয়াত দ্বারা সেক্যুলারিজমকে সমর্থন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সংবিধানসহ অনেক প্রচলিত আইনে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করা হয়েছে। যেমন, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা বা ধর্মকে বা ধর্মীয় কোনো উপাদানকে অপমান করা দেশের ফৌজদারী আইনে দন্ডার্হ অপরাধ হিসাবে বলা আছে। আবার দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের মূলনীতিতে ও মৌলিক অধিকারের চ্যাপ্টারে ধর্মনিরপেক্ষতা ঘোষিত হয়েছে।
মজার বিষয় হলো, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যখন ইসলাম ছিল, তখনও মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদগুলোর মধ্যে ধর্মীয়স্বাধীনতা দেয়া ছিল। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবার কারণে ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুন্ন ছিলনা ।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হয়েছিল কেবলমাত্র ম্যাজোরিটি জনগণের সেন্টিম্যান্ট অনুকুলে নেবার জন্য। ম্যাজোরিটি জনগণ না জানলেও বিজ্ঞজনেরা জানতো রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হবার কারণে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো ক্ষতি নেই।
ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন কেন? মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি রজায় রাখার লক্ষ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চার বিকল্প নেই। তাই তো আইন ও ধর্মীয় বিধিবিধানে সার্বজজনীনভাবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন দেয়া হয়েছে।
আমরা কি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন করবো? এক্ষণের আলোচনা থেকে যা বুঝা গেলো, সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন না করে পারে না।
তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা চাই বা চাইনা বলে চিৎকার চেচাঁম্যাচি কেন? এটি কেবলই অনর্থক বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যা সুস্থ্যসমাজে কোনোভাবেই কাম্য নয়। ধন্যবাদ।
লেখক: এড. আনোয়রুল ইসলাম ( বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট)
আইনজীবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, আইনগ্রন্থ লেখক।
Published From
Positive International Inc,
73-16, Roosevelt Ave Floor 2, Jackson Heights, New York 11372.
Email : voiceofkulaura2@gmail.com
Chief Editor : Shafiq Chowdhury
Editor : Abdul Quayyum
Managing Editor : Nurul Islam Emon
Design and developed by positiveit.us