সাংবাদিকতার তথ্য সংগ্রহ করা চৌর্য্যবৃত্তি নাকি পেশাবৃত্তি

প্রকাশিত: ১০:০০ পূর্বাহ্ণ, মে ৩১, ২০২১

সাংবাদিকতার তথ্য সংগ্রহ করা চৌর্য্যবৃত্তি নাকি পেশাবৃত্তি
booked.net

সাংবাদিক রোজিনার ঘটনার আলোকেই বলছি-

সাংবাদিক রোজিনা মিনিস্টিতে কেন যান? অবশ্যই তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে । তথ্য সংগ্রহ ছাড়া এ দায়িত্ব পালন হয়না।

তথ্য সংগ্রহ করাই তাঁর এ পেশার মূল উপাদান, তথ্য ছাড়া এ পেশা চলেনা। তথ্য সংগ্রহ করা তাঁর কোনো অপরাধ নয়। এখানে প্রশ্ন হলো, তিনি কী তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং কোন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তা করেছেন? তা কি আইনসিদ্ধ? প্রশ্ন হলো- কোন্ তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে পারেন আর কোন্গুলো পারেন না বা তথ্যসংগ্রহ তিনি কীভবে বা কী প্রক্রিয়ায় করবেন?

এগুলো অবশ্যই রোজিনা ইসলাম জানেন। কারণ, তাঁর পেশাজীবনে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের অনেক সফলতার গল্প রয়েছে, তিনি জনস্বার্থে অনেক বড়বড় কেলেঙ্কারী ধরিয়ে দিয়েছেন। সাংবাদিকতা না থাকলে চলমান বিশ্ব সম্পর্কে মানুষ থাকতো অজ্ঞ। নিরবে নিবৃত্তে চলতো পৃথিবীর সকল দুবৃত্তায়ন, যা মানুষ হয়তো কোনোদিও জানতে পারতো না।

পৃথিবীটাই অজানা থাকতো মানুষের কাছে। তাইতো সাংবাদিকতাকে একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকতার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তার কথা এখানে নাইবা বললাম। এটি আরেকটি বিশদ আলোচনা।

আরো পড়ুনঃ সমালোচনা কি, কেন এবং এর আদর্শ মানদ- কি?

আমরা জানি, সাংবাদিকতায় প্রধানতঃ দুরকমের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রথমতঃ যা ঘটে এবং প্রকাশযোগ্য এবং সে ঘটনার তথ্যের কোনা পরিবর্তন, সংযোজন বা বিশ্লেষণ না করেই হুবহু ঘটনাটি সাধারণ রিপোর্টিং এর মাধ্যমে জনসম্মুখে নিয়ে আসা।

অপরটি হলো, অনুসন্ধানের মাধ্যমে বিশেষ তথ্যাবলী সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রকাশ করা। যাকে আমরা অনুসন্ধানী রিপোর্টও বলে থাকি। অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরীর কাজটি অনেকটা গোয়েন্দাগিরীর মতো। তবে নিছক গোয়েন্দাগিরী নয়। এরকম ঘটনার তথ্যগুলো তো আর খুশীমনে কেউ দেবেনা। তাই এরকম রিপোর্টের তথ্য সংগ্রহও করতে হয় গোয়েন্দাগিরী বা গোপনীয়তা বা নানান কৌশল অবলম্বন করে অত্যন্ত সতর্কতার মাধ্যমে।

কারণ, এতে জনগণের স্বার্থ জড়িত থাকলেও মোটাদাগে বলা যায়, তা দ্বারা কোনো ব্যাক্তির (জড়িত অভিযুক্ত অপরাধী বা দুর্ণীতিবাজ) সর্বনাশ হতে পারে, অন্যদিকে আরও দেখতে হয়, রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি হবার আশংকা আছে কিনা।

এখানে আবার প্রশ্ন, কতুটুকু গোয়েন্দাগিরী বা কৌশল অবলম্বন করা আইনসিদ্ধ? কোনো আইনে কি এবিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা আছে? না, বলা নেই। রোজিনা ইসলাম তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তি করেছেন নাকি শুদ্ধ প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহের কাজটি করেছেন এবং তথ্যটাই বা কি ছিল? তিনি একজন সফল অনুসন্ধানী রিপোর্টার হয়েও তা কি জানতেন না? তবে কেন অযথা হয়রানী!

আমরা জানি, চোরাই মামলায় উদ্ধারকৃত চোরাইপণ্য এক্সিবিট বা দাখিল করতে হয়, বলতে হয় চোরাই কার্য্যরে বিস্তারিত বিবরণ। বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারা এবং অফিসিয়্যাল সেক্রেট্স আ্যাক্ট-১৯২৩ এর ৩ ও ৫ ধারায় যে মামলাটি রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে করা হয়েছে তা আইনসিদ্ধভাবে চলে কিনা বা ধারাগুেেলা বিচারে গিয়ে টিকে কিনা? ঘটনার তদন্ত হবে, মামলার খোরাকের যোগান দিবেন বাদিপক্ষ।

বিজ্ঞ আইন কৌশলীরা পক্ষে ও বিপক্ষে কথা বলবেন, যুক্তি দেখাবেন। আর দিনশেষে এ সংশ্লিষ্ট সবগুলো প্রশ্নের মীমাংসা করবেন বিজ্ঞ আদালত। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিজ্ঞ আইনজীবি ও আদালতের হাতে ভালভাল আইন দিতে হবে। সকলের জন্য কল্যাণকর আইন করতে পারেন কেবল আইনপ্রণেতারা। এক্ষেত্রে তাঁদের সদিচ্ছা থাকা অতীব জরুরী। তাঁরাই মুখ্য, আর সবই গৌণ।

বর্তমান যুগ, ডিজিটাল যুগ। সাংবাদিকতাকে সংকোচিত করার অনেক আইন আছে। তারমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮, অফিসিয়্যাল সেক্রেট্স আ্যক্ট-১৯২৩সহ নানান রকমের আইন রয়েছে। কিন্তু সঠিক ও আইনশুদ্ধভাবে নিরাপত্তার সহিত সাংবাদিকতা করার জন্য কি কোনো আলাদা আইন রয়েছে? যদি না থাকে, কেন নাই?

সাংবাদিকতাকে যেনো চৌর্যবৃত্তি বলা না যায় তদুপরি তা যেনো কেবলই পেশাবৃত্তি থাকে, অপরদিকে সাংবাদিকতা যেনো হলুদ বা অপসাংবাদিতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে সেজন্য যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকতাকে সুরক্ষা দিতে ও আইনী কাঠামোতে ফেলতে একটি যুগোপযোগী আইনের কি কোনো প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে এবং আমাদের সবাইকে জনস্বার্থে সেপথেই এগুতে হবে। তা নাহলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদেরকে ক্ষমা করবেনা। ধন্যবাদ।

লেখক-  এড্ মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম (বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট)

আইনজীবি, আইনগ্রন্থ লেখক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

Ad