বিশ্ব আদিবাসী দিবস আজ। মুজিববর্ষে কুলাউড়ায় আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আদায়ের দাবি।

প্রকাশিত: ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৯, ২০২১

বিশ্ব আদিবাসী দিবস আজ। মুজিববর্ষে কুলাউড়ায় আদিবাসীদের ভূমির অধিকার আদায়ের দাবি।
booked.net

 

আব্দুল কুদ্দুসঃ- আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে; “কাউকে পেছনে ফেলে নয়, আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকারের আহবান”। কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা, কুলাউড়া সদর, ব্রাহ্মণবাজার ও বরমচাল এই ৪টি ইউনিয়নের প্রায় ৩৩টি পুঞ্জিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠি বসবাস করছেন।

এই ৪ ইউনিয়নের ৩৩টি পুঞ্জিতে খাসিয়া, গারো, মণিপুরী, সাওতাল, উরাও ও মুন্ডা সম্প্রদায় মিলে প্রায় ১২ হাজার লোকের বসবাস রয়েছে। আদিবাসীদের জীবন-জীবীকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পানচাষ। আদিবাসীদের দাবী- পান, বন এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠি একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত।

কুলাউড়ার বিভিন্ন পুঞ্জিতে আদিবাসীদের জীবন-যাপন কেমন চলছে- জানতে গিয়ে ওই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সাথে কথা হয়। একান্ত আলাপকালে তারা জানান- তাদের নিজস্ব জগত, বসতভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর তারা অধিকার হারাতে বসেছে। যে পাহাড় ও বনকে তারা স্বতঃসিদ্ধ বলে তাদের ঐতিহ্যগত অধিকার হিসেবে দেখতো, সেখানেও আজ তারা অনেকটা বঞ্ছিত হতে যাচ্ছেন। আদিবাসীরা জানান, বন সংরক্ষণ ও উন্নয়নের নামে এখানকার অনেক পুঞ্জির প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক বৃক্ষ যেভাবে উজাড় হচ্ছে, এতে জীববৈচিত্র একসময় ধ্বংস হবেই। একসময় পাহাড় তথা অরণ্য বিরানভূমিতে পরিণত হবে।

আদিবাসীদের দাবী- ঝড়-তুফানে গাছপালা এমনকি ডাল ভেঙ্গে পড়লেও বনবিভাগ অযতা তাদের উপর মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করে। উপজেলার নোনছড়া, বেলুয়া পুঞ্জির মত আরো পুঞ্জিতে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে খাসিয়াদের। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এতে আদিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কোন কোন পুঞ্জিতে মালিকপক্ষের হয়ে পুঞ্জি ও জুম দখল করে নেওয়া হয়েছে। প্রতিকার চেয়েও কোন লাভ হচ্ছেনা। পাল্টা আদিবাসীরা হুমকির শিকার হচ্ছেন। ভয়ে পুঞ্জি থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছেনা। আদিবাসীরা নিজভূমিতেই এখন হতে যাচ্ছেন সংখ্যালঘু। পাহাড়ে রিজার্ভ ফরেস্ট, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদির নামে জুম দখল করার চেষ্টা চলছে।

আদিবাসী নেতৃবৃন্দ বলেন- ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ রেকটিফাই করেন। এতে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের কাগজ বা দলিল থাকুক বা না থাকুক, যে জমি ঐতিহ্যগতভাবে ওরা ব্যবহার করে, সে জমি তাদের। কিন্তু এর আলোকে জাতীয় পর্যায়ে আইন বা নীতিমালা হয়নি এখনো। বঙ্গবন্ধু রেকটিফাই করে গেছেন। বাকিরা পরের কাজগুলো করেননি। তারা আরো জানান, আইএলও কনভেনশনের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ঐতিহ্যগতভাবে অধিকৃত ভূমির উপর যৌথ কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকার করতে হবে’ আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবং এ সবের আলোকে আইন না থাকায় আদিবাসীরা তাদের ভূমি রক্ষা করতে পারছে না।

কুলাউড়ার মুরইছড়া ইকো-পার্ক কিংবা অন্যান্য পুঞ্জিতে সামাজিক বনায়ন করতে এখানকার আদিবাসী জনগোষ্ঠি কিংবা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কোনরুপ আলাপ-আলোচনা ও তাদের মতামত নেওয়া হয়নি। কর্মধায় মুরইছড়া ইকো-পার্কের উদ্বোধন হয়েছিল ২০০১ সালে। পরে আদিবাসীদের আন্দোলনের ফলে ইকো-পার্কটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তাদের দাবি, সরাসরি তারা উচ্ছেদ না হলেও সদর ইউনিয়নের কাঁকড়াছড়া পুঞ্জিতে কৌশলগত কারণে উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন অনেকেই।

তাছাড়া জাল দলিল দিয়ে ভূমি দখল, আইনের ফাঁক ফোকর ও নানারকম মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাদের স্বর্বশান্ত করা হচ্ছে। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবিও জানান তারা।

আদিবাসী দিবসে তাদের দাবী- ভূমি ও সম্পদের উপর অধিকার নিশ্চিত করা; সমতলের আদিবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠন করা; বংশ পরম্পরায় ভূমির মালিকানা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া ও আদিবাসীদের সামাজিক মালিকানা জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়া।আদিবাসীরা মূলত কৃষিজীবী। কিন্তু ভূমি হারানোর কারণে আজ অনেকেই কষ্টের জীবন-যাপন করছে। যে জমির তারা মালিক ছিল সেই জমিতেই আজ তাদের অনেকেই দিনমজুরের কাজ করছে। ফলে তাদের মূল পেশা কৃষিতে টিকে থাকতে পারছে না।

ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করার মতো প্রতিষ্ঠানিক কোন সুযোগ-সুবিধা তাদের নেই। ফলে তাদের ভাষা চর্চা হচ্ছেনা, ভাষা আজ হুমকির মুখে। মাতৃভাষা চর্চা সরকারীভাবে হওয়া খুবই জরুরী বলে তারা মনে করেন। তাদের সংস্কৃৃতির চর্চা হয় শুধুমাত্র গীর্জাতে। সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ায় তাদের উৎসবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। অভাব-দারিদ্র তাদের জীবনকে সরিয়ে দিয়েছে। আদিবাসীদের বসবাস একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সুতরাং বিভিন্ন সরকারী সুযোগ-সুবিধা ও নাগরিক অধিকার থেকেও তারা বঞ্ছিত বলে মনে করেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পুঞ্জি এলাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানতো দূরের কথা কোন প্রাথমিক প্রতিষ্ঠানও নেই। এতে করে অনেক দূরে গিয়ে তাদের পড়ালেখা করতে হচ্ছে।

আদিবাসী দিবসে তাদের দাবি- আদিবাসীদের জমিগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফেরত দিতে হবে। এটি করলে তারা টিকে থাকতে পারবে, পাশাপশি তাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে।
আদিবাসীরা আরো জানান, তাদের ভূমি অধিকার বাস্তবায়ন না করলে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়িত হবে না। কারণ ভূমি অধিকারের সঙ্গে অন্য সব অধিকার জড়িত রয়েছে। ভূমির সঙ্গে আদিবাসীদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে।

আদিবাসীরা যদি ভূমির অধিকার ফিরে পায় তাহলে অন্য সব অধিকারই তারা পাবে। আর মুজিববর্ষেই তারা ভূমি অধিকার পেতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

Ad