প্রকাশিত: ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৬, ২০২১
সরেজমিন প্রতিবেদন
আব্দুল কুদ্দুসঃ-কুলাউড়া উপজেলার ডলুছড়া পুঞ্জির পানজুমে হাজার হাজার প্রাকৃতিক গাছপালা থাকার পরও সেখানে নতুন করে সামাজিক বনায়নের প্রকল্প নিয়েছে বনবিভাগের স্থানীয় বিট কার্যালয়। প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সামাজিক বনায়নের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে খাসিয়াদের জীবন-জীবীকার একমাত্র উৎস পানচাষ ধ্বংস হবে। ফলে ওই খাসিয়া পুঞ্জির ৫০ পরিবারের অন্তত ৩শ’ জনগোষ্ঠি বিলীন হতে পারে।
খাসিয়াদের অভিযোগ, ডলুছড়া পানপুঞ্জির জুমে সামাজিক বনায়ন করতে ছোট কালাইগিরিতে কতিত উপকারভোগীরা একটি ক্যাম্প স্থাপন করছে। মুরইছড়া বনবিটের বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার উপকারভোগীদের নিয়েই সেখানে যান এবং তারই উপস্থিতিতেই জুমের পান ও গাছ কাটা হয়। এদিকে বিট কর্মকর্তা জানান, ডলুছড়ায় সামাজিক বনায়নে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমোদন রয়েছে। আর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এখনও তিনি অনুমোদন দেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের ডলুছড়া পানপুঞ্জি ও জুম এলাকা সরকারের একোয়ার ফরেস্টের আওতায় রয়েছে। এখানে খাসিয়ারা দীর্ঘদিন থেকে বংশ পরম্পরায় পান চাষসহ বিভিন্ন ধরণের ফলের আবাদ করে আসছে। ডলুছড়া পানজুম এলাকায় বিভিন্ন প্রাকৃতিক বনজ ও ফলজ গাছ রয়েছে। তারা জানান, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে পুঞ্জির পানজুমে সামাজিক বনায়ন দেখতে চান না। তারা এই প্রকল্পকে সামাজিক বনায়নের নীতিমালার পরিপন্থি বলেও অভিহিত করেন। তারা বলেন, প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণে খাসিয়ারা সব সময় ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ডলুছড়া পানপুঞ্জির পানজুম খুবই দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এখানকার খাসিয়ারা বংশ পরম্পরায় দীর্ঘদিন থেকে বসবাস এবং পানচাষ করে আসছেন। পানজুম এলাকায় অন্তত ২০/২৫ বছরের পুরনো প্রাকৃতিক গাছপালা রয়েছে। রয়েছে বাঁশ বাগান। খাসিয়ারা জানান, পানজুমের নিরাপত্তার স্বার্থে জুমের নিচ এলাকার সীমানা দিয়ে বনজঙ্গল রাখতে হয়। কিন্তু প্রায় দুই সপ্তাহ পূর্বে জুমের নিচের বনজঙ্গল ও গাছপালা কেটে সেখানে সামাজিক বনায়নের নামে গাছের চারা লাগাতে গর্ত করা হয়েছে।
প্রায় এক মাস পূর্বে ওই জুম এলাকার পান ও বিভিন্ন প্রকারের গাছও কর্তন করা হয়েছে। এমনকি সেখানকার বাঁশ ও গাছ আগুণে পুড়ে দেওয়া হয়েছে। খাসিয়ারা জানান, এভাবে জুমের জায়গা আস্তে আস্তে সামাজিক বনায়নের নামে দখল করা হচ্ছে। খাসিয়ারা আরো জানান, বনবিভাগের লোকজন গাছ কেটে পাল্টা মিথ্যা মামলায় তাদেরকে জড়ানো হচ্ছে।
জানা যায়, ডলুছড়া পানজুমে সামাজিক বনায়নের নামে কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলী ও গনকিয়া গ্রামের ধর্নাঢ্য পরিবারের লোকজন উপকারভোগীর তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। এরমধ্যে আছেন, গত বছর কাটাবাড়ি পানজুম দখলের মূলহোতা ও পূর্বটাট্টিউলি গ্রামের মৃত আব্দুস ছত্তারের ছেলে রফিক মিয়া, বশির মিয়া, একই গ্রামের হারুন মিয়া, উস্তার মিয়া, হারিছ আলী, ইসরাইল আলী, সাতির আলী, সাতির মিয়া ও গনকিয়া গ্রামের মুসলিম মিয়া।
এরা সবাই ধর্নাঢ্য পরিবারের লোক বলে জানা গেছে। ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার প্রভাব খাটিয়ে যেকোন মূল্যে সামাজিক বনায়ন বাস্তবায়নের কথাও জানান তারা। আদিবাসীরা জানান, গত বছর পূর্বটাট্টিউলি গ্রামের রফিক মিয়া ইছাছড়া পুঞ্জির বাসিন্দা জেসপার আমলরংয়ের কাটাবাড়ি জুম দখল করেন। পরে প্রশাসনের সহযোগিতায় জুমটি দখলমুক্ত হয়। এই রফিক মিয়ার একটি পানজুম বর্তমানে বেলকুমা পুঞ্জিতে (ফানাই পুঞ্জি) রয়েছে। আর বেলকুমা পুঞ্জির পাশেই ডলুছড়া পানপুঞ্জির জুম অবস্থিত। সেই হিসেবে সামাজিক বনায়নের নামে রফিক বাহিনী ডলুছড়া পানপুঞ্জির জুমও তাদের দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় আদিবাসীরা জানান, রোশনাবাদ মৌজার ১নং খতিয়ানভুক্ত ১০৫ নং দাগে বাঁশবন রকম ২৮৬.৫০ একর ভূমির মধ্যে ১৪০.৪০ একর বেলকুমা ও ১৪৬.৫০ একর ভূমি ডলুছড়া পুঞ্জিতে বিদ্যমান রয়েছে। এই ভূমিতে আদিবাসীরা বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে।
বিগত জরিপকালে এস.এ রেকর্ড ভুলক্রমে সরকার বাহাদুরের নামে প্রস্তুত হওয়ায় তৎকালীন পুঞ্জির হেডম্যান রোজবেল খাসিয়া মৌলভীবাজার সাব-জজ প্রথম আদালতে স্বত্ত্ব মামলা (২৬/৯৯ইং) দায়ের করেন। এতে সরকারের পক্ষে রায় ও ডিক্রি হয়। রোজবেল খাসিয়া এই রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে জেলা সাব জজ আদালতে স্বত্ত্ব আপিল মামলা (৬৭/২০০৮ইং) দায়ের করলে পরবর্তীতে রায় ও ডিক্রি তার (রোজবেল খাসিয়া) পক্ষেই আসে। তবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নালিশা ভূমি থেকে খাসিয়াদের বেদখল করার পায়তারা ও হুমকির প্রেক্ষিতে কুলাউড়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে স্বত্ত্ব মামলা (১১৮/২০১১ইং) ও স্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা করেন তৎকালীন হেডম্যান রোজবেল খাসিয়া। বিজ্ঞ আদালত ২০১১ সালের ১৭ জুলাই নিষেধাজ্ঞার আদেশ জারি করলে সেই আদেশ এখনও বলবৎ রয়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিজ্ঞ আদালতের আদেশ অমান্য এবং প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে সেখানে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কোন যৌক্তিকতা নেই। সামাজিক বনায়নের নামে পান জুমের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করলে খাসিয়াদের জীবীকানির্বাহের একমাত্র আয়ের উৎস পানও ধ্বংস হবে। ফলে আয়ের আর কোন উৎস থাকবে না। এতে করে ৫০ পরিবারের অন্তত ৩শ’ খাসিয়া জনগোষ্ঠি উচ্ছেদ আতংকে দিন কাটতে হচ্ছে।
সরেজমিন ডলুছড়া পুঞ্জির পানজুমে গেলে আরও দেখা যায়, জুমের ভিতর তাবু টাঙ্গিয়ে খাসিয়া পরিবারের লোকজন কয়েক শিপটে পাহারা দিচ্ছেন। আলাপকালে পুঞ্জির বাসিন্দা তিমন খাসিয়া জানান, “আমাদের পূর্বপুরুষরা দীর্ঘদিন থেকে পুঞ্জিতে বসবাস করে আসছেন। পানজুমে ২০/২৫ বছর আগের পুরনো বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা রয়েছে।
বিভিন্ন প্রজাতির গাছ জড়িয়ে আছে পানগাছ। পান ছাড়া খাসিয়াদের আর তেমন কোন আয়ের পথ নেই। কিন্তু আমাদের পান গাছ কাটা হয়েছে। সামাজিক বনায়নের নামে অন্যান্য জাতের গাছ কাটা হয়েছে। বস্তির লোকজনদের দিয়ে এইসব গাছ কেটে বনবিভাগের লোকজনই অন্যত্র বিক্রি করে তাদের পকেট ভারী করে।
প্রতিবাদ করলেই আমাদের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা দিয়ে অযথা হয়রানি করে। আমরা আর কত হয়রানির শিকার হবো? আর কত এভাবে রাত-দিন পাহারা দিব? প্রশাসনের কাছে দাবী রেখে তিনি বলেন- প্রাকৃতিক বন থাকা সত্তে, সামাজিক বনায়নের নামে এখানকার গাছপালা যেন উজাড় করা না হয়।” পাহারারত অবস্থায় একই দাবী জানান, ময়মনসিংহ নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী রনাল্ডো লাম্বা ও ঢাকা নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী ফাইমন সুঙ।
পাহারায় থাকা অনেকেই জানান, “গত দুই সপ্তাহ থেকে আমরা জুমে বৃষ্টিতে ভেজে পাহারা দিচ্ছি। সুবিধাভোগিরা যেকোন সময় জুমে উঠতে পারে। রফিক মিয়ার নেতৃত্বাধীন বাহিনী জুমের পাশে আনাগোনা দেয়। যেকোন সময় সুযোগ পেলেই জুমে উঠবে। আমরা চাইনা, এভাবে জুমের পান ও গাছ কাটা হোক। কারণ, গাছ পুড়ে যাওয়ায় আমাদের সম্পদ পুড়ানো হচ্ছে”। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, উপকারভোগীদের মধ্য থেকে খাসিয়াদের কাছে বড় অঙ্কেও চাঁদা দাবী করা হয়েছে। এই চাঁদা পরিশোধ করলে খাসিয়াদের আর কোন সমস্যা হবেনা।
পুঞ্জির হেডম্যান লবিং সুমের অভিযোগ করে বলেন, মুরইছড়া বনবিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জুম এলাকায় সামাজিক বনায়নের কাজে বাধা দিলে জুমের সব পানগাছ কেটে ফেলা হবে এবং খাসিয়াদের নামে মামলা দেওয়া হবে। এমনকি এখান থেকে তাদেরকে (খাসিয়াদের) উচ্ছেদ করারও ভয় দেখান তিনি।
স্থানীয় এক আদিবাসী নেত্রী জানান, পানপুঞ্জির পানচাষী ও বসবাসকারী খাসি আদিবাসীরা মালিক স্বত্ববান দখলদার থাকার মর্মে বিজ্ঞ আদালত ২০১০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রায় ও একই সালের ৫ অক্টোবর ডিক্রী প্রদান করেন। বর্তমানে স্বত্ব মামলা চলমান আছে। কিন্তু খাসিদের পুঞ্জি ও আশপাশে প্রাকৃতিক বন এবং স্বত্ব মামলা থাকার পরও সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের নামে স্থানীয় ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট ডলুছড়া পুঞ্জিতে সামাজিক বনায়ন করছে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, স্থানীয় ফরেস্ট ডিপার্মেন্ট কি আইনের উর্ধ্বে?
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় নারী বিষয়ক সম্পাদক ফ্লোরা বাবলী তালাং জানান, পানজুম এবং পরিবেশ রক্ষার্থে খাসিয়ারা তাদের প্রথাগত জ্ঞানে ৫ থেকে ১০ বছর পানজুমকে সংরক্ষণ করে রাখে। যাতে জুমের ওই গাছ প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠে। ওই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কতিত বনবিভাগ সামাজিক বনায়ন করার চেষ্টা করছে। এটি খাসিয়াদের উচ্ছেদের একটি কৌশলগত প্রক্রিয়া বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরো জানান, এখানে প্রাকৃতিক গাছপালা কেটে কৃত্রিম বন কিংবা সামাজিক বনায়ন হলে শুধু খাসিয়া নয়, বন, পরিবেশ ও প্রতিবেশও হুমকির সম্মুখিন পড়বে। তিনি ডলুছড়া পানপুঞ্জির জুম ও প্রাকৃতিক বন রক্ষা এবং সেখানে সামাজিক বনায়ন না করার জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবী জানান।
মুরইছড়া বনবিটের কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। তবে উপকারভোগীদের নিয়ে তিনি সামাজিক বনায়নের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এখানকার উপকারভোগীদের নামের তালিকাও আছে। ডলুছড়ায় সামাজিক বনায়নের জন্য সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে আবেদন প্রেরণ করা হয়েছে এবং ওই বন কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে সেটি অনুমোদনও পেয়েছে বলে তিনি নিশ্চিত করেন বিট কর্মকর্তা অর্জুন কান্তি দস্তিদার।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, সামাজিক বনায়ন করতে হবে খালি জায়গায়। যেখানে প্রাকৃতিকভাবে গাছপালা আছে সেখানে এসবের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করিনা। তবে বিষয়টি সুরাহার জন্য দুয়েক দিনের মধ্যে তিনি বনবিভাগ, ডলুছড়া পুঞ্জির খাসিয়া নেতৃবৃন্দ, উপকারভোগী ও স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়ে বসবেন বলেও জানান।
গতকাল মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, কুলাউড়ায় অনেক সামাজিক বনায়ন হয়েছে। ডলুছড়ায় সামাজিক বনায়নের বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলতে পারছিনা। তিনি বলেন, সামাজিক বনায়নের জন্য আগে জায়গা নির্ধারণ করা হয়। জায়গা নির্ধারণ, উপকারভোগীদের বিষয়টি উপজেলা বন কমিটি ও রেঞ্জার দেখবেন। তিনি বলেন, তার অনুমোদনের পর সামাজিক বনায়নের প্রকল্প চূড়ান্ত হয়। তিনি এরকম কিছু এখনও পাননি এবং অনুমোদনও দেননি বলে জানান।
Published From
Positive International Inc,
73-16, Roosevelt Ave Floor 2, Jackson Heights, New York 11372.
Email : voiceofkulaura2@gmail.com
Chief Editor : Shafiq Chowdhury
Editor : Abdul Quayyum
Managing Editor : Nurul Islam Emon
Design and developed by positiveit.us